Logo
×

Follow Us

বিশেষ প্রতিবেদন

সার সিন্ডিকেটে পুরোনো ডিলাররা, ভুগছে কৃষক

Icon

জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২৫, ২৩:৫৩

সার সিন্ডিকেটে পুরোনো ডিলাররা, ভুগছে কৃষক

আমন মৌসুম ঘিরে মাঠ পর্যায়ে সারের কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। আওয়ামী ঘরানার এক দল ডিলার এ সংকট সৃষ্টির নেপথ্যে কাজ করছেন। অতিরিক্ত দামে সার কিনতে গিয়ে বিপদে পড়ছেন কৃষক। 

এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বলয় ভাঙতে সরকার মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে। ডিলারশিপ বাতিল এবং একটি নতুন নীতিমালা তৈরির কাজও করছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর সরকার বদলের এক বছর হতে চললেও সারের বাজারের নিয়ন্ত্রণ আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া ডিলারদের হাতেই রয়ে গেছে। এসব ডিলারের অনেকে পালিয়ে বেড়ালেও তাদের লাইসেন্সের বিপরীতে সার বরাদ্দ থেমে নেই। কোনো কোনো আওয়ামী লীগ নেতার পরিবারের একাধিক সদস্যের নামে সারের লাইসেন্স আছে। সরকার পতনের পর থেকেই এ চক্র কৃত্রিম সার সংকট তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। 

কৃত্রিম সংকট

কৃষকদের অভিযোগ, যে সার সরকারি দরে ডিলারদের থেকে পাওয়ার কথা, তা মিলছে না। অথচ গ্রামগঞ্জের দোকানে সারের অভাব নেই। খুচরা দোকানির কাছ থেকে সার কিনতে গেলে দিতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। এখানে বড় সিন্ডিকেট কাজ করছে। তাদের চক্রের ফাঁদে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রান্তিক চাষি।

ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়ার তিন ধরনের সার চুয়াডাঙ্গার চার উপজেলার সরকারি ডিলার পয়েন্ট থেকে উধাও হয়ে গেছে। অথচ এ সারই খুচরা পর্যায়ের ডিলারদের কাছে মিলছে বেশি দামে। চুয়াডাঙ্গা সদরের পীরপুর গ্রামের কৃষক মিনারুল ইসলাম বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে ডিলারের ঘর থেকে প্রতি বিঘা জমিতে মাত্র ১০ কেজি সার পাওয়া যাচ্ছে। অথচ আমার প্রয়োজন ৩০ কেজি। মোট ছয় বিঘা জমিতে আমার যে পরিমাণ সার লাগবে, এর ছিটেফোঁটাও মিলছে না। 

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে টিএসপি সার মজুত করায় গত মঙ্গলবার ব্যবসায়ী বাদশা মিয়ার ঘর থেকে ১৩৩ বস্তা টিএসপি সার জব্দ করা হয়। উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে, উদ্ধার হওয়া সার বিসিআইসি ডিলার ননী গোপাল সরকার ও মৃত প্রদীপ সরকারের নামে বরাদ্দ ছিল।

নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে বিসিআইসি ডিলারদের বিরুদ্ধে ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি এবং সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দরে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট বাজারে বিসিআইসির ডিলারের বিরুদ্ধে সার বিক্রিতে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ২৪ জুলাই সড়ক আটকে বিক্ষোভ করেন কৃষকরা। 

মাগুরা সদরের গাংনালিয়া বাজারে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রির দায়ে গত রোববার মেসার্স মাবিয়া ট্রেডার্সকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অভিযানে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে টিএসপি সার এক হাজার ৬৫০ টাকায় ও ডিএপি সার এক হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রির অভিযোগ প্রমাণিত হয়। 

আওয়ামী লীগ নেতারা ডিলার

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) সারের ডিলার আছেন সাত হাজার ১৫০ জন। এর মধ্যে বিএডিসি অনুমোদিত পাঁচ হাজার ২২ জন এবং বিসিআইসির দুই হাজার ১১৮ জন। এসব ডিলার অধিকাংশই আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পেয়েছেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিএডিসি নন-ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারের জোগান দিয়ে থাকে। বিএডিসির পাশাপাশি নন-ইউরিয়া সার আসে বেসরকারি আমদানিকারকের মাধ্যমে। স্থানীয় উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে ইউরিয়ার জোগান দেয় বিসিআইসি। 

১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ঝিনাইদহে বিসিআইসির ১৩ জন সার ডিলার ছিলেন। ১৯৯৬ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত সেখানে ডিলার দাঁড়িয়েছে ৬৭ জনে। এর মধ্যে ৫০ জনের ডিলারশিপ আওয়ামী লীগের সাবেক দুই এমপিসহ দলীয় নেতাদের নামে। এর মধ্যে আট থেকে ১০ ডিলার মামলার কারণে এখন পলাতক। এসব আওয়ামী লীগ নেতা পালালেও তাদের ডিলারশিপের অনুকূলে সার কেনাবেচা ঠিকই চলছে।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০০৯ সালে হবিগঞ্জের মাধবপুরের ১১ ইউনিয়ন ও এক পৌরসভায় আওয়ামী লীগ নেতাদের ডিলার নিয়োগ দেয় সরকার। অভিযোগ রয়েছে, সেই সময় যে ১২ জনকে ডিলারশিপ দেওয়া হয়, তারা ছাড়া আর কাউকে আবেদনের সুযোগই দেওয়া হয়নি। যারা নিয়োগ পেয়েছিলেন, তারা আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের শরিক এবং জাতীয় পার্টির কর্মী-সমর্থক। এর মধ্যে আবার একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তিও রয়েছেন। বিসিআইসি সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ-সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা ২০০৯-এর ৩.২ উপধারায় উল্লেখ আছে, ‘নিজ মালিকানায় অথবা ভাড়ায় ইউনিয়ন পরিষদ/ পৌরসভায় বিক্রয়কেন্দ্রসহ কমপক্ষে ৫০ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন গুদাম থাকতে হবে।’ তবে তা অধিকাংশ ডিলারের নেই। 

পুরোনো নীতিমালায় সিন্ডিকেট ভাঙা কঠিন

অভিযোগ রয়েছে, ইউনিয়নভিত্তিক ডিলার নিয়োগের নিয়ম থাকলেও অনেক ডিলার নিজের ইউনিয়নের স্থায়ী বাসিন্দা নন। ফলে তারা উপজেলা শহর বা অন্য এলাকায় ব্যবসা চালিয়ে কৃষকদের দুর্ভোগ বাড়াচ্ছেন। ফরিদপুর, নাটোর, কুষ্টিয়া, মাগুরা, কিশোরগঞ্জ, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ইউনিয়নে নির্ধারিত ডিলার থাকলেও সেখান থেকে সার তোলা যাচ্ছে না। ডিলাররা সার স্থানীয়ভাবে দোকানে রাখেন না, বরং উপজেলার সদরের বাজারে তুলে তা বিক্রি করেন। ফলে কৃষকদের অতিরিক্ত পরিবহন খরচ গুনতে হচ্ছে।

বর্তমানে বিএডিসি ও বিসিআইসি আলাদা সংস্থা হলেও তারা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বিএডিসি শুধু নন-ইউরিয়া সার বরাদ্দ দেয়, আর বিসিআইসি দেয় শুধু ইউরিয়া। দুই সংস্থার ডিলারদের আলাদা বরাদ্দ থাকায় কৃষককে দুই দোকানে ঘুরতে হয়। আবার দুই সংস্থাই ডিলার নিয়োগ করে। কৃষি বিশ্লেষকরা মনে করেন, শুধু বিএডিসির হাতেই ডিলার নিয়োগের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। 

বিসিআইসির ডিলারদের লাইসেন্স নবায়নের সময় বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) অনুমোদন বাধ্যতামূলক। অভিযোগ রয়েছে, এ সনদের পেছনে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করে সিন্ডিকেট। 

এ পরিস্থিতিতে বিএডিসি ও বিসিআইসির আলাদা নীতিমালা এক করে ‘সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ-সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা ২০২৫’ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে ডিলারদের তথ্য চেয়ে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ১০ আগস্টের মধ্যে চাওয়া হয়েছে উপজেলা ও জেলা সার এবং বীজ মনিটরিং কমিটির মতামত। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সব ডিলারের তথ্য হালনাগাদ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান মনে করেন, সারভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থাপনা টিকিয়ে রাখতে হলে রাজনৈতিক ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিএডিসি-বিসিআইসির দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ বাদ দিয়ে ডিলারশিপ দিতে হবে সমন্বিত নীতিমালায়। প্রতিটি লেনদেনে ভাউচার বাধ্যতামূলক করা এবং ডিজিটাল ট্র্যাকিং চালু করতে হবে।

কৃষি উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, এখন থেকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ডিলারশিপ দেওয়া হবে না। সারের লাইসেন্স নিয়ে আগে যারা ঝামেলা করেছে, তাদের বাদ দেওয়া হচ্ছে। এখান নতুন করে লাইসেন্স দেওয়া হবে। এ জন্য শিগগিরই একটি নীতিমালা করে যোগ্যদের বিবেচনায় নেওয়া হবে।  আগামী নভেম্বর পর্যন্ত সার সংকট হবে না। 

Logo