Logo
×

Follow Us

বিশেষ প্রতিবেদন

ঋণ আর অনিশ্চয়তায় দিশেহারা কৃষক: আত্মহত্যা নাকি কাঠামোগত হত্যা?

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩:৪১

ঋণ আর অনিশ্চয়তায় দিশেহারা কৃষক: আত্মহত্যা নাকি কাঠামোগত হত্যা?

ছবি সংগৃহীত

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা বারবার সংবাদ শিরোনামে আসছে। গত স্বাধীনতা দিবসে মেহেরপুরের মুজিবনগরে পেঁয়াজচাষি সাইফুল শেখ বিষপানে আত্মহত্যা করেন। (সমকাল, ১৮ আগস্ট ২০২৫)। কেন তিনি এমন দিনটিকে শেষ অবলম্বন হিসেবে বেছে নিলেন, তা হয়তো আর জানা যাবে না। তবে এটিকে কেবল একটি আলাদা ঘটনা হিসেবে দেখা অনেকটাই ভ্রান্ত হবে, কারণ এর আগে ও পরে একই ধরনের আরও ঘটনা ঘটেছে।

রাজশাহীর মোহনপুরে চলতি আগস্টে আকবর হোসেন নামের এক কৃষক নিজস্ব পানের বরজে গলায় ফাঁস দেন। তাঁর ছেলে জানান, চার লাখ টাকার এনজিও ঋণের বোঝা ও প্রতিদিনের কিস্তির চাপ তার বাবাকে দিশেহারা করে তুলেছিল। কয়েক দিন আগেই একই জেলায় মিনারুল হক ঋণ ও খাদ্যাভাবে হতাশ হয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যা করে নিজেও প্রাণ দেন। তাঁর রেখে যাওয়া চিরকুটে লেখা ছিল—“ আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে। এত কষ্ট আর মেনে নিতে পারছি না।” (প্রথম আলো, ১৫ আগস্ট ২০২৫)

মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত রাজশাহী, নাটোর, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ অন্তত ছয় জেলায় কৃষকের আত্মহত্যার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।

ঋণের ফাঁদে কৃষক

দেশের আড়াই কোটি মানুষ সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত হলেও কৃষি খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের মাত্র ৩৪ শতাংশ প্রকৃত কৃষকের হাতে পৌঁছায়। বাধ্য হয়ে কৃষকেরা এনজিও, দাদন ব্যবসায়ী বা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নেন, যেখানে সুদের হার দাঁড়ায় ২০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত। সরকারি কৃষিঋণের সুদ তুলনামূলক কম হলেও এর প্রাপ্যতা অত্যন্ত সীমিত। ফলে অধিকাংশ চাষিই দেনার বোঝা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।

উৎপাদন খরচ বাড়ার আশঙ্কা

এরই মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আসায় নতুন করে সারের দাম বৃদ্ধির শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে সরকার ভর্তুকি দিয়ে প্রতি কেজি ইউরিয়া ২৭ টাকায় সরবরাহ করছে, কিন্তু গ্যাসের দাম বেড়ে গেলে এ খরচ দ্বিগুণ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে, যা সরাসরি কৃষকের মাথায় চাপিয়ে দেবে বাজার ব্যবস্থা ও নীতিগত দুর্বলতা।

সংকটের সামাজিক প্রভাব

ঋণের চাপে অনেক কৃষক কৃষিজমি বিক্রি করে গ্রামে টিকতে পারছেন না। কেউ কেউ পরিবারকে ছেড়ে শহরে চলে যাচ্ছেন দিনমজুর বা রিকশাচালকের পেশায়। ফলে গ্রামে নারী কৃষকের সংখ্যা বেড়ে গেছেতাঁরা স্বল্প মজুরিতে খেতমজুরের কাজ করে সংসার টিকিয়ে রাখছেন। অনেক কৃষক আত্মহত্যা না করেও কার্যত কৃষিপেশা থেকে ছিটকে গিয়ে সামাজিক মৃত্যু বরণ করছেন।

করণীয়

বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষকের আত্মহত্যা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি কাঠামোগত সংকটের প্রতিফলন। এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন

·        কৃষিঋণ সহজলভ্য করা ও সুদহার নিয়ন্ত্রণ

·        এনজিও ঋণের ওপর কঠোর নজরদারি

·        সার ও অন্যান্য উপকরণে ভর্তুকি কার্যকর রাখা

·        কালোবাজারি ও সিন্ডিকেট ভেঙে বাজারে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা

·        কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরাসরি রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ

·        হিমাগার ও সংরক্ষণ অবকাঠামো সম্প্রসারণ

কৃষকের ঘামে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। অথচ আজ সেই কৃষক দারিদ্র্য, ঋণ ও অনিশ্চয়তায় ঘেরাও হয়ে আত্মহত্যায় বাধ্য হচ্ছেন। তাই এটিকে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে না দেখে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা জরুরি। কৃষি খাতে সংস্কার ছাড়া এ পরিস্থিতি বদলানো সম্ভব নয়।

Logo