Logo
×

Follow Us

বিশেষ প্রতিবেদন

১৬ বছর পর কৌশল বদলে সার আমদানিতে বড় সাশ্রয়

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২২:১৫

১৬ বছর পর কৌশল বদলে সার আমদানিতে বড় সাশ্রয়

ফাইল ছবি

সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচায় সার আমদানি করে সরকার। এ অর্থবছরের শুরুতেই সেই আমদানিতে ঘটেছে ব্যতিক্রমী ঘটনা। এক কার্যাদেশেই সরকারের সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ২৩৪ কোটি টাকা। 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ১৬ বছর পর কৌশল বদলের কারণে দীর্ঘদিনের শক্তিশালী সার সিন্ডিকেট ভেঙে গেছে। এতে ভর্তুকির চাপ কমবে, কৃষকও সাশ্রয়ী দামে সার পাবেন।

অতীতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সার আনার দরপত্রে সিন্ডিকেট গড়ে উঠত। আগে বাজারদর তদারকি করা হতো না। কয়েক ব্যবসায়ী মিলে ইচ্ছামতো দর নির্ধারণ করে দিতেন। বাজারদরের চেয়ে ১২০ থেকে ১৫০ মার্কিন ডলার বেশি দিয়ে সরকারকে সার কিনতে হতো। এবার সেই সুযোগ আর থাকছে না। 

কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাজারদর যাচাই করে এখন থেকে সর্বনিম্ন হার নির্ধারণ করবে সরকার। দরদাতাদের সেই দরের ভিত্তিতে প্রস্তাব দিতে হবে। এতে সরকারের বিপুল অর্থ সাশ্রয় হবে। প্রভাবশালী কারও পক্ষে তদবির করার সুযোগ নেই। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি বা কারসাজির চেষ্টা করলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে শুধু সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হচ্ছে। গত ১৯ আগস্ট প্রথম ধাপে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে তিন লাখ ৭৫ হাজার টন সার সরবরাহের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় ধাপে আরও ছয় প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় দুই লাখ ১০ হাজার টন সার সরবরাহের আদেশ। 

এ ব্যাপারে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করায় এবার বড় অঙ্কের সাশ্রয় হয়েছে। ফলে কৃষকের কাছে সার আরও সাশ্রয়ী হবে এবং সরকারের ভর্তুকি খরচও কমবে। সিন্ডিকেটের কারণে অনেকে অসন্তুষ্ট হতে পারে, তবে সবার আগে দেশ ও কৃষকের স্বার্থ।

বাংলাদেশে সার আমদানির ইতিহাস নানা নয়ছয়ে ভরা। এর বড় দৃষ্টান্ত বিসিআইসির ৭২ হাজার ৬৮০ টন ইউরিয়া গায়েব হয়ে যাওয়া। প্রায় ৫০৮ কোটি টাকার সেই সার পরিবহন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্স গুদামে না পৌঁছে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয়। প্রতিষ্ঠানটির মালিক সাবেক এমপি কামরুল আশরাফ খান পোটন দীর্ঘদিন ধরেই সার ব্যবসায় প্রভাবশালী ছিলেন। পরিবহন ঠিকাদারির দখলও ছিল তাদের হাতে। ফলে সরকার কোটি কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এবারের দরপত্রে ৪৮টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। শেষ পর্যন্ত ১২টি প্রতিষ্ঠান কার্যাদেশ পায়। কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবে অস্পষ্টতা থাকায় প্রথমে বাদ দেওয়া হলেও পরে ব্যাখ্যা দিয়ে তারা সুযোগ পেয়েছে। ডায়ামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) আনা হচ্ছে জর্ডান, মিসর ও চীন থেকে। আগের তুলনায় টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) আমদানিতে সবচেয়ে বেশি সাশ্রয় হয়েছে– টনপ্রতি ৩৪ থেকে ১০৭ ডলার পর্যন্ত কম দামে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। মরক্কো ও লেবানন থেকে টিএসপি এনে সরকার মোট ৫২ লাখ টাকার বেশি সাশ্রয় করেছে। এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) রাশিয়া থেকে আমদানি করা হচ্ছে, টনপ্রতি বাজারমূল্যের চেয়ে তিন ডলার কমে। শুধু এই সাশ্রয়েই সার আমদানিতে সরকারের সাশ্রয় হচ্ছে ২৩৩ কোটি ৬১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। 

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এবার যে প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ায় দরপত্র হয়েছে তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সিন্ডিকেটের আধিপত্য ভেঙেছে। অতীতে যেখানে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে সরকার কোটি কোটি টাকা হারাত, এখন প্রতিযোগিতার ফলে উল্টো সরকারের পক্ষে সাশ্রয় হচ্ছে।

কৃষি উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আমরা চাই, কৃষকের কাছে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাশ্রয়ী দামে সার পৌঁছাক। এ জন্য যে কারও স্বার্থে আঘাত লাগতে পারে, সেটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। এবার আমরা প্রমাণ করেছি– স্বচ্ছ দরপত্রে সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সার আমদানিতে আরও কয়েকশ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুসরণ ও দরপত্রে স্বচ্ছতা আনার এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। তা না হলে পুরোনো সিন্ডিকেট আবার সক্রিয় হতে পারে। একই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে সারের বিতরণ ও পরিবহনের ক্ষেত্রেও কড়া নজরদারি জরুরি। কারণ অতীতে দেখা গেছে, গুদামজাত ও পরিবহনে কারসাজির কারণে বিশাল অঙ্কের সরকারি অর্থ গায়েব হয়ে গেছে।

Logo