সার আমদানির এক টেন্ডারেই ২৩৪ কোটি টাকা সাশ্রয়
১৬ বছর পর ভাঙল শক্তিশালী সিন্ডিকেট

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০৩

বাংলাদেশের কৃষি আজও সারনির্ভর। ধান, শাকসবজি, আলু কিংবা পেঁয়াজ—যে ফসলই হোক, সারের যথাসময়ে প্রাপ্যতা ছাড়া উৎপাদন ধরে রাখা কঠিন। আর খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে সার সরবরাহই সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ কারণেই প্রতিবছর সরকার বিপুল অর্থ ব্যয়ে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সার আমদানি করে।
চলতি অর্থবছরে সেই আমদানির প্রথম কার্যাদেশেই ঘটেছে ব্যতিক্রমী সাফল্য। সরকারের সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ২৩৪ কোটি টাকা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ১৬ বছর পর এমন কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়েছে, যার ফলে দীর্ঘদিনের শক্তিশালী সার সিন্ডিকেট ভেঙে পড়েছে।
কীভাবে এলো সাশ্রয়
গত ১৯ আগস্ট কৃষি মন্ত্রণালয় ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়—৩০ হাজার মেট্রিক টন টিএসপি, ২ লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন ডিএপি এবং ৯০ হাজার মেট্রিক টন এমওপি আমদানির জন্য। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় ধাপে আরও ৬টি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয় ৯০ হাজার মেট্রিক টন টিএসপি ও ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন ডিএপি সরবরাহের জন্য।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, এই দুই ধাপের কার্যাদেশেই সরকারের সাশ্রয় হয়েছে ২৩৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা। মূল কারণ, প্রতিটি সারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দেশের জন্য একটিই দর নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সব আমদানিকারকের জন্য সেই দর সমানভাবে প্রযোজ্য করা হয়েছে। আগে ভিন্ন ভিন্ন দরে অর্ডার দেওয়ার সুযোগে আমদানিকারক বাড়তি মুনাফা করতো।
সারের আন্তর্জাতিক দর নির্ধারণ হয় দুটি বিশ্বস্বীকৃত সাপ্তাহিক বুলেটিনে প্রকাশিত সর্বশেষ মূল্যের ভিত্তিতে—আরগুস (ARGUS-FMB) ও ফার্টিকন (FERTECON)। বাংলাদেশ সরকারও বহু বছর ধরে এই বুলেটিনের দামকে মানদণ্ড ধরে দর নির্ধারণ করে আসছে। এ বছর দরপ্রস্তাব জমা দেওয়ার সময় কিছু আমদানিকারক সরকারি দপ্তরের প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে টনপ্রতি ২৫ থেকে ১৫০ মার্কিন ডলার বেশি দরে প্রস্তাব দিয়েছিল। মন্ত্রণালয় সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সর্বনিম্ন দর বা প্রাক্কলিত মূল্যের ভিত্তিতেই কার্যাদেশ দিয়েছে। ফলে সরকার বিপুল অর্থ সাশ্রয় করেছে।
ভাঙল দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট
বাংলাদেশের সার আমদানিতে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের এক ধরনের সিন্ডিকেট বহু বছর ধরে প্রভাব বিস্তার করে আসছিল। সরকারি টেন্ডারে ভিন্ন ভিন্ন দরে অর্ডার ভাগাভাগি করে তারা মুনাফা করত। এবারের নতুন নীতি সেই পথ বন্ধ করে দিয়েছে।
ফলে সিন্ডিকেটভুক্ত কিছু ব্যবসায়ী ক্ষুব্ধ হয়ে এখন নানা গণমাধ্যমে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ ছড়াচ্ছে বলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ। তাদের লক্ষ্য সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা।
বাংলাদেশে নন-ইউরিয়া সারের আমদানিতে সরকারি (জি-টু-জি) উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি আমদানিকারকেরাও যুক্ত। ২০১৫ সালের নীতিমালায় বলা আছে, সর্বনিম্ন মূল্যের ক্রমানুসারে বেসরকারি আমদানিকারকদের ভর্তুকির আওতায় আনা হবে। এ বছরও সেই নীতিমালা মেনে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে।
যদি এই প্রক্রিয়া অনুসরণ না করা হতো, তবে টনপ্রতি ২৫ থেকে ১৫০ ডলার বেশি দরে সার আমদানির সুযোগ তৈরি হতো। এতে সরকার বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো এবং বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় ঘটত।
কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সিদ্ধান্ত হয়েছে, নির্দিষ্ট সারের জন্য নির্দিষ্ট দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন দর প্রদানকারীদের কাছ থেকেই ক্রয়াদেশ দেওয়া হবে। এর ফলে চলতি বছরেই সরকারের প্রায় ২৩৪ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, কোনো প্রকার অনুরাগ বা বিরাগ দেখানো হয়নি। প্রতিটি দেশের জন্য নির্ধারিত একটিই দর প্রযোজ্য করা হয়েছে, যা সব আমদানিকারকের জন্য সমানভাবে কার্যকর।
কৃষি উপদেষ্টা লে. জে. মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নির্দেশনায় সারের সরবরাহে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হওয়ার ফলেই কৃষকরা প্রতিকূল সময়েও উৎপাদন ধরে রাখতে পেরেছেন। এ বছর দেশে শাকসবজি, আলু, পেঁয়াজ, ধান, আমসহ বিভিন্ন ফসলের বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রতিকূল সময়েও সার সরবরাহ নিশ্চিত থাকায় কৃষকেরা দুশ্চিন্তামুক্ত ছিলেন।
মন্ত্রণালয় বলছে, সার আমদানিতে সাশ্রয় হওয়া অর্থ ভবিষ্যতে কৃষি ভর্তুকি ও খাদ্য নিরাপত্তা জোরদারে ব্যয় করা সম্ভব হবে।