Logo
×

Follow Us

জাতীয়

সাদিক এগ্রো উচ্ছেদ রাজনৈতিক আক্রোশের জের?

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৫, ২২:২৭

সাদিক এগ্রো উচ্ছেদ রাজনৈতিক আক্রোশের জের?

২০২৪ সালের জুলাই মাসের ছবি (বামে), বর্তমান ছবি (ডানে)

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বহুল আলোচিত সাদিক এগ্রো খামার উচ্ছেদ হয়েছিল খাল দখলের অভিযোগে। কিন্তু এক বছরেরও কম সময়ে সেই জায়গায় উঠে গেছে বহুতল ভবন। খাল দখলের অভিযোগে সাদিক অ্যাগ্রোকে উচ্ছেদ করা হলে নতুন ওঠা ভবনের বিষয় নীরব ভূমিকায় ডিএনসিসি। স্থানীয়দের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বিরোধের কারণে সাদিক এগ্রো ধ্বংস করা হয়েছে। যার সুযোগ নিয়েছে প্রভাবশালী একটি পক্ষ।

২০২৪ সালের ২৭ জুন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মোহাম্মদপুরের গাবতলী-সদরঘাট বেড়িবাঁধ সড়কের সাতমসজিদ হাউজিংয়ের ১ নম্বর সড়কে সাদিক এগ্রোর দুটি খামার গুঁড়িয়ে দেয়। অভিযোগ ছিল, খামারটি রামচন্দ্রপুর খালের জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে। পুরো খামার ভাঙচুর করে উচ্ছেদ করা হলেও খালের পাশেই তখনকার বিদ্যমান বহুতল ভবন ও অন্যান্য খামারে হাত পড়েনি।

এর মধ্যে দুটি প্লটে অটোরিকশার গ্যারেজ, একটি খালি এবং আরেকটিতে উঠছে বিশাল ১০ তলা ভবন। সরেজমিনে দেখা গেছে, বহুতল ভবনটির পঞ্চমতলার কাজ চলছে পুরোদমে।

২০২৪ সালের ২ জুন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সেমিনারে ইমরান হোসেনর গ্রেপ্তার দাবি করেছিলেন কৃষক লীগের সভাপতি সমীর চন্দ

ব্যক্তিগত জমি নাকি খালের জায়গা?

স্থানীয় কয়েকজন দাবি করেছেন, সাদিক এগ্রো আসলে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে খামার করেছিল, যা ভাড়া নেওয়া হয়েছিল মালিকদের কাছ থেকে। প্লটগুলোর মালিক আব্দুল আলীম তালুকদার, প্রয়াত আবুল কালাম আজাদের স্ত্রী-সন্তান, বসির আহমেদ এবং মোহাম্মদ আলী আকন্দ। তারা সবাই বলছেন, জায়গাটি তাদের নামে হালনাগাদ কাগজপত্র আছে, জমি খালের নয়।

ব্যক্তিগত রেষারেষির জেরে তাদের খামার উচ্ছেদ করা হয় বলে অভিযোগ করেন সাদিক অ্যাগ্রোর বর্তমান ম্যানেজার (ব্যবস্থাপক) জাহিদ উদ্দিন। তিনি বলেন, খালের জায়গা বলে আমাদের খামার ভাঙা হয়েছে, একই জায়গায় এখন জমির মালিকরা অটোগ্যারেজ আর বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে। কথাগুলো আমরা তখনো বলেছি, এখনো বলছি—এগুলো ব্যক্তি মালিকানার জায়গা, আমরা ভাড়া নিয়েছিলাম। আমাদের সুনামহানি করার জন্য একটা পক্ষ তখন উঠেপড়ে লেগেছিল। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের দেওয়া খালের সীমান পিলার এখনও আছে। সাদিক এগ্রোর খামার সীমানা পিলার থেকে দূরে ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ আসলে বিগত কয়েক বছর যাবৎ খামার থেকে গরু বিক্রয়ের উপর হাসিল প্রদান সংক্রান্ত বিষয়ে দেন দরবার করে আসছিল। উল্লেখ্য যে, দেশের আইনে খামার হতে গরু-ছাগল ক্রয় বিক্রয়ের কোন প্রকার হাসিল প্রযোজ্য নয়। আওয়ামী লীগ নেতারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তখন সাদিক এগ্রোর মালিক ইমরান হোসেনকে বিএনপির পৃষ্ঠপোষক আখ্যা দিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেসব ভিডিও এখনও ইউটিউবে আছে।

গরুর মাংসের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারকেই দায়ী করে সংবাদ সম্মেলন করেন ইমরান হোসেন

আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিরোধ ও চাঁদাবাজির অভিযোগ

স্থানীয় খামারিদের অভিযোগ, খামার উচ্ছেদ অভিযানের আগে সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা প্রত্যেক খামারির কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন। সাদিক এগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন এ বিষয়ে প্রতিবাদ করায় কর্মকর্তারা ক্ষিপ্ত হন। তাছাড়া, মেয়র আতিকুল ইসলামসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে তার বিরোধ ছিল। এ ছাড়া ভারত থেকে গরুর মাংস আমদানি বন্ধে সাদিক এগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন কয়েকবার সংবাদ সম্মেলন করেছেন। গরুর মাংস আমদানি বন্ধ হাইকোর্টেও তিনি রিট করেছিলেন। ইমরান বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স এসোসিয়েশেনর সভাপতি হিসেবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়েও তখন সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। ২০২৪ সালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আব্দুর রহমানের দুগ্ধ দিবসের অনুষ্ঠান বয়কট করে একই সময়ে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনের সংবাদ সম্মেলনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অনিয়ম-দুর্নীতি গণমাধ্যমে তুলে ধরেন ইমরান হোসেন। তখন তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান ইমরানকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। কৃষক লীগের সভাপতি সমীর চন্দ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি) মিলনায়তন ও শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে সাদিক এগ্রোর মালিক ইমরান হোসেনকে বিএনপির পৃষ্ঠপোষক আখ্যা দিয়ে গ্রেপ্তার দাবি করেছিলেন। ওই সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগে শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্তেই সাদিক এগ্রো ভাঙা হয়, অথচ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান অক্ষত থাকে।

সাতমসজিদ হাউজিং সোসাইটির নিরাপত্তা তত্ত্বাবধায়ক আব্দুর রহমান বলেন, এটা খালের জায়গা কখনো ছিল না। সাদিক এগ্রোর সঙ্গে রাজনৈতিক প্যাঞ্জাম ছিল, সেই সুযোগে ভাঙা হয়েছে।

২০২৪ সালের ১ জুন সকালে মন্ত্রীর দুগ্ধ দিবসের অনুষ্ঠান বয়কট করে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অনিয়ম-দুর্নীতি তুলে ধরেন ইমরান হোসেন

কর্মসংস্থান হারানো মানুষের দুর্দশা

সাদিক এগ্রোতে প্রায় ৫০০ জন মানুষ কাজ করতেন। স্থানীয়রা বলেন, খামার থাকাকালে এলাকায় জমজমাট ব্যবসা ছিল, বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল। খামার ধ্বংস হওয়ার পর সেই কর্মসংস্থান উধাও হয়েছে, অনেক মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন।

খালের ভরাট জায়গায় আগে যেসব পরিবার ছাপরা ঘর তুলে থাকত, তাদেরও উচ্ছেদ করা হয়েছিল। বর্তমানে আবারও ৮-১০টি পরিবার সেখানে ঝুপড়ি তুলে বসবাস করছে। ষাটোর্ধ্ব বাবুল হোসেন বলেন, ১৬ বছর ধরে এখানে আছি। উচ্ছেদের পর কয়েক মাস রাস্তায় থেকেছি। সাদিক এগ্রোর মালিক নিয়মিত আমাদের সহায়তা করতেন। সাদিক এগ্রো না থাকায় এখন মানবেতর জীবন কাটাচ্ছি। তিনি বলেন, সাদিক এগ্রো করোনার সময় ব্যাপকভাবে ত্রাণ বিতরণ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি রমজান মাসে এলাকার কয়েক হাজার মানুষের জন্য ইফতারের আয়োজন করতো। কেউ অসুস্থ হলেই সহায়তা করতো।

স্থানীয় চা দোকানি জসিম আলম বলেন, সাদিক অ্যাগ্রোর জায়গা ব্যক্তিমালিকানাধীন জানতাম। খামার উঠাইছে স্থানীয় কাউন্সিলরসহ গত সরকারের স্থানীয় ছোট নেতারা, সাদিক অ্যাগ্রোর মালিকের লগে খারাপ সম্পর্কের কারণে। মূলত স্থানীয় কাউন্সিলরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল মালিকের।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. জুয়েল বলেন, সাদিক এগ্রোতে ৫০০ জনের মতো মানুষ কাজ করত। বড় একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ছিল। ভেঙে দেওয়ার পর সবাই তো কর্মহারা।

ভারত ও মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে দেশে গরু-মহিষ আনা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করেন ইমরান হোসেন

ডিএনসিসির নীরবতা

সাদিক এগ্রোর জায়গায় বহুতল ভবন গড়ে ওঠার বিষয়ে ডিএনসিসির কর্মকর্তারা কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন। অঞ্চল-৫-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ছাদেকুর রহমান বলেন, আমি নতুন এসেছি, বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখব।

প্রশ্ন থেকেই যায়

খালের জায়গা দখলের অভিযোগে একটি কৃষি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেওয়া হলো, অথচ অল্প সময়ের মধ্যেই সেখানে বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। যদি জায়গাটি খালের হয়, তবে কীভাবে সেখানে ভবন হচ্ছে? আর যদি জায়গাটি ব্যক্তিমালিকানাধীন হয়, তবে কেন সাদিক এগ্রোকে উচ্ছেদ করা হলো?— এমন প্রশ্ন তুলছেন স্থানীয়রা।

Logo