কৃষিকে লাভজনক পেশায় রূপান্তরের চেষ্টা করছি

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৫, ২২:১১

সমকাল : কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে আপনি দায়িত্ব নিয়েছেন। এত বড় একটি মন্ত্রণালয়ে আপনার অল্প দিনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলবেন?
এমদাদ উল্লাহ মিয়ান : কৃষি মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম ১৭ কোটি মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখানে মানুষের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার সুযোগ আছে। দায়িত্ব পালন করছি আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে। যোগদান করার পরই বড় দুটি বন্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কৃষির। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। দ্রুত বীজতলা তৈরি করে তা কৃষকের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। অনেক এলাকায় আগাম রবিশস্য চাষ করা হয়েছে। কৃষককে প্রণোদনাও দেওয়া হয়েছে। এরপর সার সংকটের মতো চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে। উপদেষ্টা মহোদয়ের পদক্ষেপের কারণে সারের সংকট অনেকটা কেটে গেছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত সারের মজুত আছে। আরও সার পাইপলাইনে আছে। সংকট হবে না।
সমকাল: কৃষিপণ্যে সিন্ডিকেটের কথা প্রায়ই শোনা যায়। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও সিন্ডিকেট ভাঙতে কী উদ্যোগ নিয়েছেন?
এমদাদ উল্লাহ মিয়ান: গত অক্টোবরে সবজি ও ডিমের দাম নিয়ে উদ্বেগের মধ্যেই নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকি মূল্যে সবজি-ডিমসহ নানা কৃষিপণ্য বিক্রি শুরু করেছি। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো ওএমএসের আওতায় কৃষিপণ্য বিক্রি হচ্ছে। বাজারেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। কৃষকও ন্যায্য দাম পাচ্ছেন। এ ছাড়া বিপণন অধিদপ্তরকে আরও কার্যকর করা হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সংযোগ তৈরি করতে বাজার নিয়ে নিয়মিত গবেষণা হবে। আধুনিক বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।
অনেক ক্ষেত্রেই কৃষিপণ্য উৎপাদন নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। নির্ভুল পরিসংখ্যান প্রণয়ন করা হবে। তথ্য সংগ্রহকারীদের সঙ্গে পরিসংখ্যান ব্যুরোও থাকবে, যাতে দুটি সংস্থার তথ্য এক রকম হয়। সঠিক তথ্য থাকলে পরিকল্পনা নেওয়া সহজ হয়। আমদানির ক্ষেত্রেও সঠিক তথ্য প্রয়োজন। এতে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া সহজ হবে। চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের জোগান দেওয়া যাবে।
সমকাল : কৃষকের কাছে সঠিক সময়ে সার ও বীজ যাচ্ছে না। এ সমস্যা কীভাবে দূর করবেন?
এমদাদ উল্লাহ মিয়ান : সার ও বীজের ক্ষেত্রে কিছু সিস্টেমে সমস্যা রয়েছে। যে পরিমাণ সার আমদানি হয়, তা সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত গোডাউন নেই। গোডাউন না থাকায় অনেক সময় খোলা আকাশের নিচে সার নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের অনেক মিল বন্ধ রয়েছে। তাদের অনেক বড় বড় গোডাউন আছে। সার মজুত রাখতে এগুলো ব্যবহার করা যাবে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে কথা হয়েছে। গোডাউনে থাকলে সারের বিষয়টি নজরদারির মধ্যে রাখা সম্ভব। সার ব্যবস্থাপনাকে সম্পূর্ন ঢেলে সাজিয়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। সিসি ক্যামেরা থাকবে গোডাউনে। এতে সার কখন আসছে কখন বের হচ্ছে, কোনো অনিয়ম হচ্ছে কিনা, তা দেখা যাবে। তখন সার নিয়ে আর কোনো উদ্বেগ থাকবে না। সরকারের বড় অঙ্কের টাকার অপচয়ও বন্ধ হবে।
আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কৃষি বিজ্ঞানীরা যে বীজ উদ্ভাবন করেন, তা কৃষকের হাতে সঠিকভাবে যায় না। নতুন নতুন উদ্ভাবন কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। বীজ মাঠে সম্প্রসারণে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান, সিড অ্যাসোসিয়েশন, বীজ ব্যবসায়ী ও কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনকে যুক্ত করে বীজ ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হবে। এতে বীজ আমদানি কমবে এবং কৃষকও সঠিক সময়ে বীজ হাতে পাবেন। বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিকেও ঢেলে সাজাব। বীজ ব্যবস্থাপনাকে পুরোপুরি অনলাইনভিত্তিক করব। এ ছাড়া ইউনিয়ন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের দুটি গ্রুপকে আমি টার্গেট করেছি।
সমকাল : অতীতে দেখা গেছে বড় প্রকল্প নেওয়ার প্রতিযোগিতা ছিল। এসব প্রকল্প আসলে কতটা কার্যকর?
এমদাদ উল্লাহ মিয়ান : কৃষির পরিকল্পনা অনুবিভাগকে আরও শক্তিশালী করা হবে। এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক বিষয় চিন্তা করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হবে। সে অনুযায়ী প্রকল্প প্রণয়ন করা হবে। ইতোপূর্বে গৃহীত অনেক প্রকল্পই বাস্তবসম্মত নয়। সেগুলো পরিবেশের সঙ্গে সবক্ষেত্রে মানানসই নয় কিংবা কৃষকেরও সেভাবে কাজে আসছে না। আমরা প্রকল্প নির্ভরতা কমিয়ে এনে পদ্ধতিগত উন্নয়ন করতে চাই। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়, আমরা পদ্ধতিগত উন্নয়ন করে প্রকল্পের কাজ সচল রাখব। কৃষি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা আছে বলে মনে করি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক জোরদার করা হবে। এক সংস্থার সঙ্গে আরেক সংস্থার সমন্বয় থাকলে কৃষক উপকৃত হবেন।
সমকাল : কৃষিপণ্যে বিশ্ববাজার ধরা যাচ্ছে না কেন?
এমদাদ উল্লাহ মিয়ান : বিদেশে ফলসহ নানা কৃষিপণ্য রপ্তানির অনেক সুযোগ রয়েছে। বাজার নিয়ে গবেষণা করব। প্রতিযোগিতায় টিকতে কী কী বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে, তা অর্জন করে রপ্তানি বাজার ধরার চেষ্টা করব।
সমকাল : কৃষি পেশাকে লাভজনক করা সম্ভব?
এমদাদ উল্লাহ মিয়ান : কৃষকই এ দেশের আসল নায়ক। অথচ তাদের সন্তানরা শিক্ষিত হয়ে আর কৃষি পেশায় যেতে পারেন না। কৃষিকে লাভজনক পেশায় রূপ্তান্তরের চেষ্টা করছি। সাধারণত কৃষক একটা ফসল তুলে তা বিক্রি করার আগ পর্যন্ত নতুন চাষাবাদে যেতে পারেন না। ফলে ১০-১৫ দিন সময় লেগে যায়। এই সময় পরের ফসলের জন্য পিছিয়ে যাচ্ছে। এতে অনেক সময় তিন ফসল আবাদ করা যায় না। আমরা একটা ফসল ওঠার পর আরেকটি গ্রুপকে নতুন ফসল লাগানোর জন্য কাজে লাগাব। কৃষকের ফসল মার্কেটিং এবং যুগোপযোগী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণকেও ঢেলে সাজাব। সব এলাকায় যাতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক কৃষি যন্ত্রপাতি যায় এবং এক্ষেত্রে কোনো পক্ষপাতিত্ব না হয়, তা বিবেচনা করা হবে। খামারি অ্যাপ নামে একটি অ্যাপ আছে। এটাকে আরও কার্যকর করব। কোন এলাকায় কোন ফসল কার্যকর, মাটি পরীক্ষার ফলাফল, সার-কীটনাশক ব্যবহারের নিয়ম, বীজের তথ্যসহ সবকিছু এ অ্যাপে থাকবে। কৃষকের কষ্টের ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হবে।