
ছবি সংগৃহীত
বর্ষা
বিদায় নিলেও লঘুচাপের কারণে ঝরছে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। এমন বর্ষণে বাড়ে ইলিশের
আনাগোনা। তবে ভরা এই মৌসুমেও সাধারণ মানুষের পাতে উঠছে না স্বাদের ইলিশ। একদিকে
কাঙ্ক্ষিত উৎপাদনে ধাক্কা, অন্যদিকে বাজারে দাম বাড়ার
কারণে রুপালি ইলিশ এবার অনেকের কাছে ‘দুর্লভ’!
প্রজনন
মৌসুমে ইলিশ ধরা বন্ধ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান
বা সহায়তাসহ নানা উদ্যোগের কারণে কয়েক বছর দেশে টানা বেড়েছিল ইলিশ উৎপাদন। তবে
এবার মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবেই দেখা গেছে,
গত
মৌসুম অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে অন্তত ৭ শতাংশ উৎপাদন কম হয়েছে। এই
জুলাই-আগস্টে ভরা মৌসুমে আহরিত ইলিশের পরিমাণ ছিল মাত্র ২৯ হাজর ৫১৯ টন। গত বছর
একই সময়ে ধরা পড়েছিল ৪০ হাজার ২৯১ টন। অর্থাৎ দুই মাসেই গত বছরের চেয়ে ১০ হাজার
৭৭১ টন উৎপাদন কম। এক দশক ধরে বাড়বাড়ন্ত ইলিশ আহরণ এবার দিচ্ছে পতনের ইঙ্গিত।
ইলিশ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট– দুই কারণই উৎপাদন কমার পেছনে ভূমিকা
রাখছে। বঙ্গোপসাগরের পানির তাপমাত্রা বাড়ার ফলে ইলিশের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ায় ইলিশের বিচরণও হয়ে পড়েছে সীমিত। মেঘনার মোহনায় ডুবোচর বেড়ে
যাওয়া, নদী ও উপকূলীয় দূষণ এবং
অতিরিক্ত আহরণও ইলিশ বিপর্যয়ের কারণ। সব সংকট কাটিয়ে শিগগির যদি নদীকে আগের
অবস্থায় ফিরিয়ে আনা না যায়, তবে ইলিশ বাংলাদেশের জলসীমা
ছেড়ে চলে যেতে পারে ভিন্ন পথে।
এ
পরিস্থিতিতে আগামী ৩ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে শুরু হচ্ছে ২২ দিনের মা ইলিশ রক্ষায়
নিষেধাজ্ঞা, যা চলবে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত।
এর পর নভেম্বর থেকে শুরু হবে আট মাসের জাটকা আহরণে নিষেধাজ্ঞা।
বরিশালের
হিজলার ধুলখোলা ইউনিয়নের জেলে ইউসুফ চৌকিদার গত রোববার ভোর ৫টা থেকে বেলা ১১টা
পর্যন্ত মেঘনায় ছিলেন। এই সময় দুবার জাল ফেলে তিনি মাত্র সাতটি ছোট আকারের ইলিশ
ধরতে পেরেছেন। এগুলো বিক্রি হয়েছে ৯০০ টাকায়। নৌকা,
জ্বালানি
খরচসহ পাঁচ জেলের ভাগে পড়েছে মাত্র ৬০ টাকা। হতাশ হয়ে পরের দিন আর তারা নদীতে
যাননি। ২৬ বছর ধরে মেঘনায় মাছ ধরেন ইউসুফ। তিনি বলেন, ভরা মৌসুমে এত কম ইলিশ কখনও দেখিনি।
ইলিশের সংখ্যা দিন দিন কমছেই।
মেঘনা
ও তেঁতুলিয়া নদী দীর্ঘদিন ধরে দেশের ইলিশ উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
কয়েক বছর আগেও এটিকে ‘ইলিশ খনি’ বলা হতো। তবে ক্রমবর্ধমান ইলিশ সংকটের
কারণে শুধু মেঘনা নয়, অভ্যন্তরীণ নদী ও সাগরেও
হাহাকার চলছে।
ভোলার
জেলেপাড়ার বাসিন্দা হোসেন মাঝি গত সপ্তাহে মেঘনায় গিয়ে মাত্র ১৫ কেজি ইলিশ ধরেছেন।
৯ জেলে আর ৪০ লিটার জ্বালানি খরচ করে এ যাত্রায় তাঁর খরচ হয়েছে ১০ থেকে ১৫ হাজার
টাকা। হাসান মাঝি হাজীপুর-শহীদপুর এলাকায় পেয়েছেন মাত্র ছয় কেজি ইলিশ। সেখানে নদীর
গভীরতা নেমে এসেছে সাড়ে সাত ফুটে। একই গ্রামের এরশাদ জানান, গত ৬ জুলাই তিনি আরও সাতজনকে নিয়ে সাগরের
৩০ কিলোমিটার গভীরে গিয়ে ফিরে এসেছেন মাত্র তিনটি ইলিশ নিয়ে। মনপুরার গজারিয়া চরের
চারপাশে বিশাল চর দেখেছি। চাঁদপুর থেকে মনপুরা পর্যন্ত বিভিন্ন চ্যানেলে এখন চর
পড়েছে, নাব্য কমে ট্রলার চলার পথ
সংকীর্ণ হয়ে গেছে বলে জেলেরা জানিয়েছেন।
মৎস্য
অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, প্রতিবছর জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর ভরা মৌসুম ধরা হয়।
বছরে মোট আহরিত ইলিশের দুই-তৃতীয়াংশই এক সময় দক্ষিণাঞ্চলের নদনদীতে পাওয়া যেত। এ
বছর জুলাই-আগস্টে ভরা মৌসুমে আহরিত ইলিশের পরিমাণ ছিল মাত্র ২৯,৫১৯.৪৬ টন।
গত
বছর একই সময়ে আহরণ হয়েছিল ৪০,২৯১.২৪
টন। অর্থাৎ মাত্র দুই মাসেই গত বছরের চেয়ে ১০,৭৭১.৭৮
টন কম। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪
অর্থবছরে দেশজুড়ে ইলিশ উৎপাদন কমে পাঁচ লাখ ২৯ হাজার টনে দাঁড়িয়েছে। আগের বছর
২০২২-২৩ সালে ছিল পাঁচ লাখ ৭১ হাজার টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের হিসাব এখনও হয়নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে, আরও কম হবে। এর আগে প্রতিবার ইলিশ উৎপাদন
সামান্য হলেও বাড়ত। ২০১৮-১৯ সালে পাঁচ লাখ ৩২ হাজার,
২০১৯-২০
সালে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার, ২০২০-২১ সালে পাঁচ লাখ ৬৫
হাজার, ২০২১-২২ সালে পাঁচ লাখ ৬৬
হাজার টন ইলিশ আহরিত হয়েছিল।
ভারত-নেপালের
বাঁধ ও পানি প্রত্যাহারের কারণে পদ্মা-যমুনা-মেঘনার প্রবাহ বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে
ব্যাপকভাবে কমেছে। এতে নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা বাড়ছে। মৎস্য অধিদপ্তরের জরিপে
দেখা গেছে, মেঘনার মোহনায় শুষ্ক মৌসুমে
লবণাক্ততা দ্বিগুণ হয়ে ১০ পিপিটিতে পৌঁছেছে। ইলিশ গবেষক আনিছুর রহমান জানান, পদ্মার হার্ডিঞ্জ সেতুর কাছে পানির প্রবাহ
৩৮-৪০ শতাংশ কমে গেলে ইলিশ উৎপাদন অন্তত ২৬ শতাংশ কমে যায়।
আবহাওয়া
অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯০১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে
বাংলাদেশের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০৫০ সালের
মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা আরও বাড়বে। অথচ ইলিশের প্রজননের আদর্শ তাপমাত্রা ২৬
থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ডিম ফোটার হার কমছে, ইলিশের পোনার মৃত্যুহার বাড়ছে। আবহাওয়াবিদ
বজলুর রশীদ বলেন, তাপমাত্রা বাড়ার বৈশ্বিক
প্রবণতা বাংলাদেশের মৎস্যসম্পদ, বিশেষ
করে ইলিশ খাতকে ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
মৎস্য
অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, মোহনাগুলোর গভীরতা কমে
যাওয়ায় ইলিশ প্রবেশে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। মোহনা সাধারণত ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার
প্রশস্ত এবং পানির গভীরতা কমপক্ষে ৫০ থেকে ১০০ ফুট থাকার কথা। ইলিশ নির্বিঘ্নে
চলার জন্য প্রায় ৩০ ফুট গভীর পানি প্রয়োজন। মোহনাগুলো ভাটার সময় পলি জমে ৮ থেকে ৯
ফুটে চলে আসে। ডুবোচর, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং
গরম পানি নির্গমনের কারণে নদীর নাব্য সংকট আরও বাড়ছে।
ইলিশ
সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্লাহ সমকালকে বলেন, মোহনা ও অভ্যন্তরীণ নদীতে নাব্য সংকট, ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্রের ধ্বংস, অবৈধ জাল ব্যবহারসহ আরও কয়েকটি সমস্যা
রয়েছে। এ সমস্যা সমাধান না হলে কয়েক বছরের মধ্যে নদীতে কোনো মাছ পাওয়া যাবে না।
মৎস্য
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুর রউফ বলেন,
নাব্য
সংকটের পাশাপাশি ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্রগুলোও ধ্বংস হয়েছে। সাগর সুরক্ষায় মৎস্য
অধিদপ্তরের কার্যক্রম নেই। এ সুযোগে অবৈধ ট্রলিং ও জাটকা নিধনের কারণে উৎপাদন
কমছে।
মৎস্য
ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন,
অবৈধ
জাল ও জাটকা নিধন পুরোপুরি বন্ধ না হওয়াসহ জলবায়ু পরিবর্তন, নদীর নাব্য হ্রাস ও অভয়াশ্রমসংলগ্ন এলাকায়
উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে ইলিশ উৎপাদন কমেছে। জাটকা সুরক্ষা ও প্রজনন মৌসুমে
নির্বিঘ্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে অভিযান পরিচালনাসহ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
কারেন্ট জালসহ অবৈধ জালের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। ইলিশের দাম নিয়ন্ত্রণে নদী থেকে
বাজারে আসা পর্যন্ত হাতবদল কমানোর পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে।