
ছবি সংগৃহীত
বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে এক নতুন ধারা স্পষ্ট হচ্ছে—বিদেশি ফলের চাষে ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছেন কৃষক ও তরুণ উদ্যোক্তারা। লাভজনক হওয়া, বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি এবং আমদানিনির্ভরতা কমানোর সুযোগ তৈরি হওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত বাড়ছে বিদেশি ফলের বাগান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২–২৩ অর্থবছরে বিদেশি ফলের উৎপাদন ছিল ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯২২ টন, যা ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫৭৭ টনে। অর্থাৎ এক বছরে উৎপাদন বেড়েছে ২১ হাজার টনেরও বেশি। একই সময়ে চাষের জমির পরিমাণও ১৫ হাজার ৪৩১ হেক্টর থেকে বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার ৫৬৮ হেক্টর।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ড্রাগন, মাল্টা, রাম্বুটান, অ্যাভোকাডো, স্ট্রবেরি, পার্সিমন ও সাম্মামের মতো উচ্চমূল্যের ফলগুলো দেশীয়ভাবে চাষে কৃষির বৈচিত্র্য ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা উভয়ই বাড়ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উদ্যানতত্ত্ব শাখার উপপরিচালক নাদিরা খানম বলেন,
“বিদেশি ফল চাষ এখন কেবল কৃষিকাজ নয়, এটি স্মার্ট কৃষির অংশ হয়ে উঠছে। স্থানীয় চাহিদা মেটানো ও আমদানি নির্ভরতা কমাতে আমরা কৃষকদের এ চাষে উৎসাহিত করছি। বাংলাদেশের জলবায়ু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বিদেশি ফল চাষের জন্য উপযোগী, যা পরিবেশের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না।”
মাঠ থেকে অভিজ্ঞতা
নরসিংদীর বেলাবো উপজেলার কৃষক আকরাম হোসেন বলেন,
“আমি পুকুরের চারপাশে রাম্বুটান চাষ করেছি। প্রথম বছরেই এক লাখ টাকার ফল বিক্রি করেছি। আগামী বছর আয় আড়াই লাখ ছাড়াবে বলে আশা করছি। বাগান থেকে ফলের দাম কেজিপ্রতি এক হাজার টাকার বেশি।”
নাটোরের সৌখিন কৃষক সেলিম রেজা ২০১২ সাল থেকে ড্রাগন ফল চাষ করছেন। বর্তমানে তিনি ‘দৃষ্টান্ত অ্যাগ্রো ফার্ম অ্যান্ড নার্সারি’ পরিচালনা করেন, যেখানে অ্যাভোকাডো ও রাম্বুটানসহ বিভিন্ন বিদেশি ফল উৎপাদিত হচ্ছে।
“আমরা এখন উন্নত জাতের ফল চাষ করছি। ড্রাগন ফলের বিঘাপ্রতি আয় ২ থেকে ৫ লাখ টাকায় পৌঁছায়,” বলেন সেলিম রেজা, যিনি কৃষিখাতে অবদানের জন্য ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশে ৮০টির বেশি পুরস্কার পেয়েছেন।
পাহাড়ি অঞ্চলে বিদেশি ফলের সাফল্য
খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানেও বিদেশি ফল চাষের প্রসার ঘটছে। রাঙ্গামাটিতে ২০২২ সালে ১,১৭৯ হেক্টর জমিতে ১০ হাজার টনের বেশি মাল্টা উৎপাদিত হয়। বান্দরবানে ড্রাগন ফল সংগ্রহ করা হয় ছয় মাসব্যাপী, যেখানে স্থানীয় বাজারে কেজিপ্রতি দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা।
নাটোরের বাড়াইগ্রামের কৃষক রবিউল করিম বলেন,
“উৎপাদন বাড়ছে, কিন্তু কৃষকের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে শক্তিশালী বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি।”
আমদানি কমাতে সহায়ক
দেশে বিদেশি ফলের উৎপাদন বাড়লেও আমদানি এখনও উল্লেখযোগ্য। ডিএই-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১৮ অর্থবছরে ৩.৫৬ লাখ টন ফল আমদানি করেছিল, যা ২০২০ সালে ৩ লাখ টনে নেমে আসে। তবে ২০২৩ অর্থবছরে আবার বেড়ে ৬.১৬ লাখ টনে পৌঁছায়। এর মধ্যে ৭৭ শতাংশই ছিল আপেল ও মাল্টা, যেগুলোর বেশিরভাগ আসে চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিশর, ভুটান ও ব্রাজিল থেকে।
উদ্যানতত্ত্ববিদ মইনুল হক বলেন,
“উচ্চশিক্ষিত তরুণরা এখন কৃষিতে ফিরছে। বিদেশি ফল চাষ তাদের কাছে লাভজনক ও আধুনিক একটি সুযোগ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।”
বাংলাদেশে বিদেশি ফল চাষ এখন শুধু অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নয়, বরং একটি নতুন কৃষি সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে উঠছে। পুষ্টি নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও আমদানি হ্রাসের মাধ্যমে এ খাত দেশের কৃষি অর্থনীতিতে নতুন গতি যোগ করছে।